Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • আগস্ট ৭, ২০২১

আমার ছেলেবেলা

নির্মলেন্দু গুণ
আমার ছেলেবেলা

ঠাকুরমার প্রেমে মগ্ন ঠাকুরদার পুকুর খনন, শিল্পী বাবার রহস্যময় হাসি আর মিষ্টি দাম্পত্য, কলকাতার আর্টকলেজ  অসমাপ্ত লেখাপড়া এবং গুণ পরিবারে প্রথম রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীর কাহিনী উঠে এল কবির নিখাদ চারণে আর সহজাত উচ্চারণে। 

‘লেখাপড়া করে যেই গাড়ি ঘোড়া চড়ে সেই’– কথাটা ঠাকুরদার জীবনে সত্য হয়েছিল। গাড়িতে না চড়লেও চারহেবারার পাল্কিতে চড়ে তিনি নেত্রকোণা যেতেন, নেত্রকোণা থেকে রেলে চড়ে ময়মনসিংহ যেতেন। বারহাট্টা তখনও রেলপথে ময়মনসিংহের সঙ্গে যুক্ত হয় নি, রেললাইনটি পরে বারহাট্টা হয়ে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত প্রসারিত হয়। আমার ঠাকুরদা পান্ডববর্জিত দুর্গম এলাকার মানুষের মধ্যে বিদ্যাবিতরণের কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি আমাদের অকালপ্রয়াত একমাত্র পিসিমার স্মৃতিরক্ষার্থে আমাদের বাড়িতে ‘স্নেহলতা বালিকা বিদ্যালয়’ নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পারিবারিক তহবিল থেকেই স্কুলের শিক্ষকদের বেতন দেয়া হতো, ছাত্রীদের কাছ থেকে কোনো বেতন নেয়া হতো না। স্কুলটি পঞ্চমশ্রেণী পর্যন্ত ছিল। এলাকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে মেয়েরা এসে স্নেহলতা বালিকা বিদ্যালয়ে পড়তো। ঐ স্কুলটি সরকারী অনুদান বা স্বীকৃতি পায় নি, ফলে ঠাকুরদার মৃত্যুর কয়েক বছর পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। স্নেহলতা বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি আমাদের বাড়ির সামনে, একটি মিডল ইংলিশ স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারী চাকুরির প্রভাব খাটিয়ে ঐ স্কুলটির জন্য তিনি প্রয়োজনীয় সরকারী স্বীকৃতি এবং বার্ষিক অনুদান-দুই-ই সংগ্রহ করেন। ওই স্কুলটি ছিল ষষ্ঠশ্রেণী পর্যন্ত। ওটাই পূর্ব-নেত্রকোণার প্রথম স্কুল (১৮৯০ খূঃ)। দূরদূরান্ত থেকে ছাত্ররা এই স্কুলে পড়তে আসতো।

১৩২৭ সালের ৭ই পৌষ আমার ঠাকুরদা লোকান্তরিত হন। আমার বাবা, তাঁর বৈমাত্রেয় বড় ভাই বড়দা গুণ মহাশয়ের উৎসাহে আর্টিস্ট হওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে যান এবং কলকাতার ন্যাশনাল আর্ট স্কুলে ভর্তি হন। সংসারের আয়-উপার্জনের ব্যাপারে বাবার খুব একটা উৎসাহ ছিল না। শিল্পীদের মতোই তিনি কিছুটা সংসারবিমুখ মানুষ ছিলেন। আর্টিস্ট হওয়ার ইচ্ছটা তিনি কোথা থেকে পেয়েছিলেন, জানি না। তাঁর আর্টিস্ট হওয়ার ব্যাপারে ঠাকুরমার সমর্থন ছিল না। ঠাকুরদার মৃত্যুর  (১৯২০ ইং) পর আমার ঠাকুরমা সংসারের একচ্ছত্র কর্ত্রীতে পরিণত হয়েছিলেন। যে-জ্যাঠামশাই বাবাকে আর্টিস্ট হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন তিনি ছিলেন বাবার বৈমাত্রেয় ভাই। ঠাকুরদার অবর্তমানে সাংসারিক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ঠাকুরমা আমাদের বৈমাত্রেয় জ্যাঠামশাইর সকল অধিকার হরণ করেন। ফলে, বাবার পক্ষে কলকাতায় থেকে আর্টস্কুলে পড়াশোনা করাটা ক্রমে দুরূহ হয়ে ওঠে। ঠাকুরমা চাইতেন না আর্টিস্ট হওয়ার পেছনে বাবা পরিবারের অর্থের অপচয় করেন। আমার আপন জ্যাঠামশাই এবং আমার কাকা এ-ব্যাপারে ঠাকুরমাকেই সমর্থন করতেন।  আমার আপন জ্যাঠামশাই বি এ. পাশ করে ময়মনসিংহ জজকোর্টে পেশকারের চাকরি করতেন। তিনি ছিলেন খুবই হিসেবি লোক। আমার কাকা রামগোপালপুরের জমিদার বাড়িতে একসময় ম্যানেজার ছিলেন; পরে ঐ চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি গ্রামে চলে আসেন। আমাদের তালুকদারির অন্তর্ভুক্ত প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার ব্যাপারে কাকা ছিলেন পারদর্শী। এলাকায় তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি বাবার চাইতে অনেক বেশি ছিল। তিনি ছিলেন যাকে বলে সাত গাঁয়ের মোড়ল, কর্তা। পরে ময়মনসিংহ জজ-কোর্টের জুরি-বোর্ডের অন্যতম অনারারী সদস্যও হয়েছিলেন। বাবা ছিলেন এসব ব্যাপারে নিতান্ত অনভিজ্ঞ এবং কিছুটা উদাসীন প্রকৃতির মানুষ। তিনি সংসারের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে নানা ব্যর্থতার পরিচয় দিতেন। এই নিয়ে ভাইদের মধ্যে মনোমালিন্য হতো। বাবা যখন তাঁর বৈমাত্রেয় অগ্রজের সমর্থনে আর্টিস্ট হওয়ার জন্য কলকাতায় চলে যান, তখন ওই কলহ এবং মতান্তর আরো তীব্র রূপ নেয়। কিছুদিন বাড়ি থেকে বাবার নামে  নিয়মিতই টাকা পাঠানো হতো, কিন্তু এ ব্যবস্থাটা বেশিদিন স্থায়ী ছিল না।  বছরখানেক পর বাবার নামে টাকা পাঠানো  বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং গ্রামে এসে সংসারের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য বাবাকে নির্দেশ দিয়ে পত্র দেয়া হয়। বাবা তখন বাধ্য হয়েই কলকাতা আর্ট স্কুলের পড়া চুকিয়ে দিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন। ময়মনসিংহ শহরে ঠাকুরদা কিছু জমি কিনেছিলেন, বাবার ওপর ওই জমিতে বাড়ি তৈরী করার দায়িত্ব বর্তায়।

শহরের কেন্দ্রস্থলে, রামবাবু রোডের পাশেই, দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে বাবা বাড়ি তৈরীর কাজ সম্পন্ন করেন। তিনভাগে বিভক্ত ঐ বাড়ির প্রতিটি ইউনিট ছিল স্বতন্ত্র এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের অনুকরণে বাড়িগুলির নামকরণ করা হয় উত্তরায়ণ, সঞ্চয়ন এবং দক্ষিণায়ন। বাড়ি তৈরী শেষ করে বাবা গ্রামে ফিরে আসেন। ঠাকুরমাকে নিয়ে জ্যাঠামশাই দক্ষিণায়নে বসবাস শুরু করেন। উত্তরায়ণ এবং সঞ্চয়ন ভাড়া দিয়ে দেয়া হয়। বাড়িগুলির নামকরণ এবং নির্মাণ-কৌশলে বাবার শিল্পীমনের ছাপ লক্ষ্য করা যায়।

কলকাতা আর্টস্কুলে কিছুদিন পড়াশোনা করার সুবাদেই আমার মায়ের সঙ্গে বাবার বিবাহ সম্ভব হয়েছিল। তা না হলে আমার মাতুল পরিবার বাবাকে মায়ের যোগ্যপাত্র বিবেচনা করতো বলে মনে হয় না।

বিয়ের পর, আমার দত্তকুলোদ্ভব মা’র সঙ্গে আমার  দত্তকুলোদ্ভব ঠাকুরমার সম্পর্কের ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকে। মায়ের অবাধ্য হয়ে কলকাতায় পড়তে যাওয়া এবং সংসারের কাজে অবহেলা প্রদর্শনের জন্য বাবার সঙ্গে ঠাকুরমার সম্পর্কটা পূর্ব থেকেই খারাপ ছিল। আমার শহুরে মায়ের সঙ্গে ঠাকুরমা যখন শাশুড়ির গ্রাম্য দাপট খাটাতে গেলেন, তখন আমার মায়ের সঙ্গেও তাঁর একটি অঘোষিত স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হয়। ক্রমশ তা প্রকট রূপ ধারণ করে।


একটি ছবিতে জনৈকা রমণী স্নান শেষে ঘরে ফিরছেন— তার ভেজা গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা শাড়িটি যেন তার গাত্রবর্ণের স্নিগ্ধ শ্যামলতাকেই প্রকাশ করছে; নগ্নপদযুগলের উপর শাড়ির লাল পাড়টা লুটিয়ে পড়ে আছে দেবীপায়ের যুগলপদ্মের মতো।


খুব ভোরে পুকুরে প্রাতঃস্নান করার রেওয়াজ আছে গ্রামে; বিশেষ করে সধবাদের। শীতের দিনেও তা থেকে রেহাই ছিল না। আমার মা ছোটবেলা থেকেই শহরে মানুষ হয়েছিলেন। গ্রাম্যজীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর কমই ছিল। তিনি ঠাকুরমার নিয়ম না মেনে, টিউবওয়েলের তোলা জলে স্নান করতেন। বাবা ছিলেন স্ত্রৈণ প্রকৃতির। তিনি প্রকাশ্যেই টিউবওয়েল থেকে মায়ের স্নানের জল তুলে দিতেন। ঠাকুরমা ব্যপারটা লক্ষ্য করেন এবং এ নিয়ে বাবা-মাকে নানা কটু কথা শোনান। ঠাকুরমা মাকে পুকুরে প্রাতঃস্নান করার নির্দেশ দেন। বাড়ির পেছনের ওই পুকুরটির প্রতি ঠাকুরমার ব্যক্তিগত দুর্বলতা ছিল। সেই দুর্বলতার  কারণ হলো, ঠাকুরদার দ্বিতীয় বিবাহের পর তার এক জ্ঞাতি-ভাই, সম্পত্তি নিয়ে যার সঙ্গে আদালতে মামলা চলছিল, নিমন্ত্রণ পেয়েও আমাদের বাড়ি আসেননি; বিদ্রুপচ্ছলে তিনি নাকি মন্তব্য করেছিলেন এই বলে যে, ‘রামসুন্দরের  সুন্দরীকে তো পুকুরঘাটেই দেখতে পাবো। বাড়িতে যাওয়ার দরকার কী?’ কথাটা ঠাকুরদার কানে পৌঁছলে তাঁর আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগে। নববিবাহিত সুন্দরী স্ত্রীকে ঐ জ্ঞাতিভ্রাতার চোখের আড়ালে রাখার মানসেই তিনি তখন রাতারাতি বাড়ির পেছনের ঐ পুকুরটি খনন করান। পুকুরের চারপাশ ঘনজঙ্গলে ঢাকা থাকায় বাইরে থেকে বোঝার উপায়ই ছিল না। প্রিয়তমা পত্নীর জন্য সম্রাট শাজাহান গড়েছিলেন তাজমহল, রামসুন্দর দিয়েছিলেন পুকুর। একঢিলে দুই পাখি মেরেছিলেন আমার ঠাকুরদা– জ্ঞাতিশত্রুকেও জব্দ করলেন, স্ত্রীর মনও জয় করলেন। তিনি কবি হলে হয়তো পুকুরের নাম রাখতেন কামিনী সরোবর। ঠাকুরমার নিশ্চয়ই গোপন দুর্বলতা ছিল ঐ পুকুরটিকে ঘিরে। তাঁর প্রিয়-পুকুরে প্রাতঃস্নানের ব্যাপারে আমার মায়ের অনীহা বোধকরি ঠাকুরমার দুর্বলতম জায়গাটিতেই আঘাত করে থাকবে। ঠাকুরদার মৃত্যুকে অকালমৃত্যু বলা না গেলেও, আমার ঠাকুরমা প্রায় বাল্যবিধবাই ছিলেন। ঠাকুরদার সঙ্গে তাঁর বয়সের পার্থক্য ছিল প্রায় তিরিশ বছর। অল্পবয়সের বিধবা শাশুড়িদের সঙ্গে পুত্রবধূদের সম্পর্ক খুব সুখের হয় না – তবে অন্য দুই পুত্রবধূর সঙ্গে ঠাকুরমার সম্পর্ক মোটামুটি ভালোই ছিল। শুধু মা’রই ছিল মন্দভাগ্য।

শেষ পর্যন্ত আমার মা, ঠাকুরমার কটুকথার অত্যাচারে, জেদ করেই কামিনীসরোবরের ঠান্ডাজলে প্রাতঃস্নান করতে শুরু করেন। এর ফল আমার মায়ের জন্য খুবই ক্ষতিকর হয়। উপর্যুপরি সন্তানের জন্ম দিতে দিতে এমনিতেই তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়েছিল– পুকুরের ঠান্ডা জলে স্নান করে তিনি অচিরেই নিউমনিয়ায় আক্রান্ত হন। আমার মায়ের অকালমৃত্যুর জন্য আমার ঠাকুরমাও কমবেশি দায়ী। ঠাকুরমা সম্পর্কে আমার কোনো সুখস্মৃতি নেই। সবারই ঠাকুরমা থাকে, আমারও ছিল। ব্যস্– এপর্যন্তই। ঠাকুরমার ঝুলি থেকে দুঃখ ছাড়া আমি আর কিছুই পাই নি। নিজের ঠাকুরমা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগছে, ঠাকুরমার অত্যাচারে কষ্ট পেয়ে আমার অসহায় মা কি কখনো ঈশ্বরের কাছে আমার মতো এক কবি পুত্রের প্রার্থনা করেছিলেন?

♦ ♦ ♦

বাবার আর্টস্কুলের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় নি, এ নিয়ে বাবার মনে খুব দুঃখ ছিল; কিন্তু ছবি আঁকা তিনি ছেড়ে দেন নি। ছবি আঁকতেন গ্রামের বাড়িতে বসেই। বিয়ের পর, মায়ের উৎসাহেই বাবা বেশ কিছু ছবি আঁকেন। তাঁর আঁকা ছবির অধিকাংশই নষ্ট হয়ে যায়। কিছু ছবি মা নিজের উদ্যোগে বাঁধিয়ে এনেছিলেন; কালের করালগ্রাস থেকে সেই ছবিগুলো  রক্ষা পায়। আমার মায়ের মৃত্যুর পরও ঐ ছবিগুলো দীর্ঘদিন আমাদের গ্রামের বাড়িতেই ছিল। পরে, আমার বড়ভাই ওই ছবিগুলো ভারতে নিয়ে যান।

একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে জনৈকা রমণী স্নান শেষে ঘরে ফিরছেন– তার ভেজা গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা ভেজা শাড়িটি যেন তার গাত্রবর্ণের স্নিগ্ধ শ্যামলতাকেই প্রকাশ করছে; নগ্নপদযুগলের উপর শাড়ির লাল পাড়টা লুটিয়ে পড়ে আছে দেবীপায়ের যুগলপদ্মের মতো। তার দীর্ঘ কালোকেশদাম একটা ডোরকাটা গামছা গিয়ে জড়ানো। মুখ বাঁ-দিকে  ঈষৎ ঘোরানো – মনে হয় অঙ্কনরত শিল্পীর দিকেই রমণীর দৃষ্টি নিবদ্ধ।

একটিতে ছবির নায়িকা স্নানশেষে শুকনো শাড়ি পরেছেন। পিঠের ওপরের এলানো ভেজাচুল এই চিত্রে বন্দী হয়েছে খোঁপায়। সলজ্জ প্রশান্তিতে ভরা তার স্নিগ্ধ মুখশ্রী, চোখের দৃষ্টি মাটির দিকে নোয়ানো। দীর্ঘ শীর্ণ দৈহিক গঠন এবং লম্বাটে মুখাকৃতি দেখে সহজেই বুঝতে পারি, এই দুই ছবির মডেল ছিলেন আমার মা। শিল্পচর্চা অব্যাহত রাখতে পারলে বাবা যে একজন উঁচুমানের শিল্পী হতে পারতেন, এ-ব্যাপারে আমার একটুও সন্দেহ নেই।

মনে হয়, মাকে মডেল করে ছবি আঁকার ব্যাপারটিও আমার ঠাকুরমা পছন্দ করেন নি। এটাও ঠাকুরমার সঙ্গে আমার মায়ের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার একটা কারণ হতে পারে। অথচ আমি বাবার মুখেই শুনেছি ঠাকুরমার বাবা, হরিশচন্দ্র দত্ত মহাশয়ও খুব চমৎকার ছবি আঁকতেন। সেদিক থেকে বলা যায়, পুত্রের মধ্যে পিতৃকৃতীর নিদর্শন লক্ষ্য করে বাবার শিল্পচর্চার প্রতি ঠাকুরমার দুর্বলতা থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক – কিন্তু বাস্তবে তা হয় নি। কেন হয় নি, তা এক রহস্য।

সংসার-জালে জড়িয়ে পড়ার ফলে ক্রমেই বাবা ছবি আঁকার উৎসাহ হারিয়ে ফেলছিলেন; মায়ের আকস্মিক মৃত্যুতে বাবার শিল্পী-জীবনের ইতি ঘটে। তিনি ছবি আঁকা একেবারে বন্ধ করে দেন। বাবা যে শিল্পী ছিলেন, তা জানবার কোনো অবকাশই আমাদের হয় নি! আমাদের দাদামণি যখন আমাদের ঘরে অযত্নে লালিত ছবিগুলো ভারতে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখন ঐ ছবিগুলোর প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহের কারণ সন্ধান করতে গিয়েই আমি প্রথম জানতে পারি যে ঐ ছবিগুলো বাবার আঁকা শুনে আমি খুবই অবাক হই এবং বাবার দিকে খুব কৌতূহলী চোখে তাকাই। ছবি এঁকে দেয়ার জন্য বাবার কাছে আমি বায়না ধরতে থাকি, কিন্তু বাবা কিছুতেই ছবি আঁকতে রাজি হন না, নানা ছুঁতোয় তিনি আমার আবদার এড়িয়ে চলেন। মনে হয় বাবা যেন মনে প্রতিজ্ঞাই করেছিলেন, আর ছবি আঁকা নয়। আমার মা কি বাবাকে ছবি আঁকতে নিষেধ করে গিয়েছিলেন? কী জানি?

তবে, একবার বাবা আমার আবদার এড়াতে পারেন নি। আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করার রেওয়াজ ছিল। রবীন্দ্রস্নেহধন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ শ্রীশৈলজারঞ্জন মজুমদারের প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী জানতে পারি যে, রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন সর্বপ্রথম পালিত হয়েছিল নেত্রকোণায়। শৈলজাবাবু আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন, তাঁর বাড়ি বারহাট্টার পার্শ্ববর্তী মোহনগঞ্জ থানায়। শৈলজাবাবু তখন শান্তিনিকেতনের সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন।পুজোর ছুটিতে বাড়ি এসে শৈলজাবাবু রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন পালনের উদ্যোগ নেন। ওটাই ছিল রবীন্দ্রজয়ন্তীর শুরু। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি নজরুলও যুক্ত হন। আমার ধারণা, নজরুল জয়ন্তীও নেত্রকোণাতেই প্রথম পালিত হয়েছিল।

বারহাট্টায়, বারহাট্টা ক্লাবের উদ্যোগে তখন একটা চমৎকার সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল গড়ে উঠেছিল। ওই ক্লাবে রবীন্দ্র ও নজরুলজয়ন্তী হতো। আমরা ওইসব অনুষ্ঠানে রচনা প্রতিযোগিতায় এবং কবিতা আবৃত্তিতে অংশ নিতাম। নজরুলের জীবনকাহিনীপাঠ করে আমি খুবই অবাক হই। নজরুলের শৈশব ছিল অত্যন্ত দুঃখের। বৈরী ভাগ্যের বিরুদ্ধে কী সংগ্রাম করেই না নজরুল কবি হয়েছিলেন। নজরুলের সংগ্রামী জীবন আমাকে খুবই আকৃষ্ট করে। আমি তাঁর সঙ্গে এক-ধরনের নৈকট্য অনুভব করি। আমাদের বাড়িতে নজরুলের জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্ত নিই, এবং বাবাকে নজরুলের একটা ছবি এঁকে দিতে বলি। বাবা এবার আর আমার কথা ফেলতে পারেন নি। তিনি অনেকদিন পর মোটা কাগজ আর কাঠের পেন্সিল নিয়ে ছবি আঁকতে বসে যান। নজরুলের ঝাঁকড়াচুলের সেই বিখ্যাত ছবিটাকে মডেল করে বাবা নজরুলের একটা চমৎকার ছবি এঁকে দেন। আমাদের বাড়ির সামনে, কাচারি ঘরের বারান্দায় স্টেজ করে, স্টেজের পেছনের কালোপর্দার মাঝখানে বাবার আঁকা নজরুলের পেনসিলস্কেচটা সেঁটে দিয়ে দিয়ে আমরা এগারই জ্যৈষ্ঠ পালন করি। বাবা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইতে পারতেন। আমাদের উৎসাহ দেয়ার জন্যই ঐ অনুষ্ঠানেবাবা একটি নজরুলগীতিও পরিবেশন করেছিলেন। ওটাই ছিল বাবার আঁকা শেষ-ছবি। ঐ ছবি আঁকার পর বাবা আরও তিরিশ বছর বেঁচে ছিলেন, কিন্তু তাঁকে দিয়ে আর কোনো ছবি আমি অনেক চেষ্টা করেও আঁকাতে পারি নি। ছবি আঁকার কথা বললেই বাবা হাসতেন, সেই হাসিটি ছিল খুবই রহস্যময়।

ক্রমশ…


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!